হাত
হাত
মধ্যপ্রদেশে মাওবাদীদের আক্রমণে সাত জন পুলিশ কর্মীর মৃত্যু হয়েছে, দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ ঘূর্ণি ঝরে পরিণত হয়েছে .......
-রেডিওটা একটু জোরে দেত।
আমাদের পড়ার মাঝখানে খবরের কাগজের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বাবা বলে উঠলো। আমাদের সমস্বরে চেঁচানোর চোটে রেডিওর আওয়াজ বাবার কান পর্যন্ত আর পৌঁছিলোনা। প্রত্যেকদিন সন্ধ্যার এইসময়টায় আমাদের পড়া থামিয়ে হয় অঙ্ক নাহয় হাতের লেখা নিয়ে বসতে হয়, নাহলে সেদিনের মতো বাইরের দুনিয়ার খবর বাবার কান পর্যন্ত পৌঁছাতো না।
দামোদর পারের এক অন্ধকার গ্রামের বাড়ির বারান্দায় কেরোসিনের আলোকে গোল করে ঘিরে আমরা পড়তে বসেছি। পাশে বাবা খাবারের কাগজ নিয়ে, বোধহয় পড়ছে কম আমাদের উপর নজর রাখছে বেশি।
প্লাস্টিকের পেনটা দাঁতে চেপে ধরে হাত বাড়িয়ে একটা ছোট চাকা ঘুরিয়ে রেডিওর আওয়াজটা বাড়িয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,
- বাবা, ঘূর্ণিঝড় কি শুধু বঙ্গোপসাগরেই তৈরী হয়?
উত্তরের অপেক্ষা না করে পাটিগণিত খুলে মাথা চুলকাতে শুরু করলাম, কারণ বাবার চোখ মোটা চশমার কাঁচের ভিতর দিয়ে খবরের কাগজের ছোট ছোট অক্ষরগুলোকে মেপে চলেছে আর কান রেডিওর দিকে। এই রেডিও জিনিসটা খুব একটা সুবিধের না। সামনে মোট তিনটে চাকা, দুটো ছোট আর একটা বড়। একটা ছোট চাকায় আওয়াজ কম বেশি হয়, বড়টাতে একটা লাল রঙের তার এদিক ওদিক নাচানাচি করে, এক এক জায়গায় থামে আর এক এক রকমের গান, খবর কখনও বা খেলা শোনায়, আরেকটা ছোট চাকা যে কি কাজ করে তা বুঝতাম না। তবে চেষ্টা কম করতামনা। সুযোগ পেলেই তাকে ধরে টানাটানি করতাম, কিন্তু ওই শক্ত ছোট চাকা কোনোদিনই ঘুরতনা। আর যেদিন খট করে আওয়াজ তুলে ঘুরে যেত, সেদিন রেডিও মশাই সারাদিন হয় মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকতো, নাহলে অদ্ভুত ভাষায় খুব আস্তে আস্তে এমন কিছু বলত যা আমরা কেউই বুঝতাম না। সন্ধ্যার সময় বাবা আবার ওটাকে আরও দু একবার খট খট করে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে বোধগম্য আওয়াজে নিয়ে আসতো।
- এটা তোরই কাজ, আবার এটাকে ঘুরিয়ে শর্ট ওয়েভে লাগিয়েদিয়েছিলি।
বাবার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে প্লাস্টিকের পেনের মাথাটা দাঁতের মাঝখানে নিয়ে চিবাতে থাকতাম। বাবার বকুনি বেচারা পেনটার শারীরিক দুরাবস্থা বাড়িয়ে দিত।
- দাদা বাড়িতে আছো নাকি ?
দরজার বাইরে থেকে আওয়াজ আসাতে রেডিও খবর বলার আওয়াজ আরো কম করল। বাবা গিয়ে দরজা খুলল
- কে? জগা? কি ব্যাপার?
জগন্নাথ ভান্ডারী, আমাদের গ্রামতুতো জগা কাকা। গ্রামেরই আরেক পাশে বাড়ি। বেশ কয়েক বিঘা চাষের জমি, কাঁচা পাকা মিলিয়ে বেশ বড় বাড়ি। বাড়িতে চাষের জন্যে ট্রাক্টার থেকে শুরু করে জমিতে জল দেওয়ার পাম্প সবই মজুত। গ্রামের বেশ কয়েকজন পয়সাওয়ালা লোকেদের মধ্যে এও একজন।
শেষ বৈশাখের মেঘলা সন্ধ্যার অন্ধকারে বাবার পশে দাঁড়িয়ে সেই আগুন্তুককে চেনা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবে বাবার কথায় বুঝলাম সে জগা কাকা, এই নামেই আমরা তাকে চিনি.
তুই আবার এখানে এলি কেন? অগত্যা কৌতূহলী কান সজাগ রেখে অর্ধ চিবানো প্লাস্টিকের পেন হাতে নিয়ে পাটীগণিতে ডুব দিলাম। নিজেদের কথা শেষ করে মাটির বারান্দায় জগা কাকাকে বসিয়ে বাবা ধোয়া এক ধুতি লুঙ্গির মতো করে পরে বাড়ির উঠোনের পেয়ারা গাছের একটা ছোট্ট ডাল ভেঙে হাতে নিয়ে বাড়ির তুলসী গাছের পশে বসল।
- একটা আলো নিয়ে আয় তো।
আমি যেন এর অপেক্ষাতেই ছিলাম। ছোঁ মেরে পাশ থেকে একটা কেরোসিনের লন্ঠন নিয়ে এক লাফে বাবার পাশে। ততক্ষনে জগা কাকাও বাবার আরেক পাশে হাজির। বয়স পঞ্চাশের ঘরে, মুখ ভর্তি কাঁচা পাকা দাড়ি, গায়ে সাদা রঙের ফতুয়া আর লুঙ্গি। দুশ্চিন্তায় ভরা চোখের উপরে কপালের ভাঁজ দেখেই বোঝা যায়, কোনো বিপদ মুক্তির আশায় বাবার কাছে আগমন। ঝিঁ ঝিঁ পোকাগুলো আমাদের তিনজনকে দেখে তাদের চিৎকার চেঁচামেচি থামিয়ে বোধহয় আমাদের কার্যকলাপ অনুমান করার চেষ্টা করছে
বাবা উঠোনে মাটির উপর বসে সেই পেয়ারা গাছের ছোট্ট ডাল দিয়ে কয়েকটা লাইন টেনে জিজ্ঞেস করল,
- কোনদিকে কটা ঘর?
- ওইতো পুব পশ্চিমে তিনটে, আর পাশে লাগোয়া রান্না চালা তার পাশে উত্তর দক্ষিণে লম্বা গোয়াল ঘর।
বিবরণ অনুযায়ী বাবা মাটিতে এঁকে চলেছে, কোন ঘরে কোথায় কটা জানালা কোথায় কোন মুখে দরজা ইত্যাদি।
এতক্ষনে আমাদের সবাইয়েরই জগা কাকার বিপদ সম্পর্কে অনুমান করা হয়ে গেছে। বছরের এই সময়টাতে, যখন বর্ষা সবে শুরু হয়েছে বা কালবৈশাখীর হঠাৎ বৃষ্টি মাঠ ঘাট ভিজিয়ে নরম করেছে, গ্রামের দিকে সাপের উপদ্রব বাড়ে। আর এই গ্রামে বা পাশের গ্রামের কারো সঙ্গে এরকম কিছু হলেই বাবার কাছে, বাবা এক মন্ত্র শক্তিতে নিজের হাতকে মাটির উপর চালিয়ে বলে দেয় যে সেই অবাঞ্ছিত জন্তুটি এখন কোথায় আছে। বাড়ির একটা নক্সা মাটিতে এঁকে দুহাত একসঙ্গে কপালে ঠেকিয়ে বাবা তার বাম হাতটা উপুড় করে মাটির ওপর সেই বাড়ির নক্সার সামনে রেখে ফিস ফিস করে মন্ত্র পড়তে লাগল। একপাশে বিপদ মুক্তির আশা নিয়ে জগা কাকা, আরেকপাশে আমি। ততক্ষনে আমার পড়ার প্রতিদ্বন্দ্বীরাও পঠন পাঠন থামিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে।
উঠোনের অন্ধকার এক কোনে তুলসী গাছের পাশে কেরোসিনের ছোট্ট লন্ঠন টাকে ঘিরে আমরা তিনজন। দূরে কালবৈশাখী মেঘের গর্জনের সঙ্গে এখানেও দু একটা করে বৃষ্টির ছোট ফোঁটা পড়তে শুরু করেছ। বৈশাখের ভীষণ এই গরমের সন্ধ্যাতে প্রকৃতি যেন থমকে দাঁড়িয়েছে, কোথাও কোনো গাছের পাতা নড়ছে বলে মনে হচ্ছে না। দুর্যোগের আয়োজনের এই নিস্তব্ধতা ভেঙে মাথার উপর দিয়ে হঠাৎ একটা পেঁচা কর্কশ গলায় কিছু বলতে বলতে উড়ে গেল। হয়তোবা আসন্ন কালবৈশাখীর ঘোষণা করে গেলো। কিন্তু বোধহয় আমি ছাড়া আর কেউই খুব একটা খেয়াল করলোনা, কারণ বাকি দুজন এখন পক্ষিকুল ছেড়ে এক সরীসৃপ এর গতিবিধি নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ।
বাবার হাত চলতে শুরু করেছে সেই নক্সার দিকে। আর নক্সার বাড়ির মালিকের অপলক চোখের দৃষ্টি বাবার হাতকে অনুসরণ করে চলেছে। হাত চলতে চলতে নক্সার এক কোনে গিয়ে থামল।
- কিছু পেলে?
- দেখছি
বাবা আবার দুই হাত কপালে ঠেকিয়ে এক ই রকম ভাবে হাত মাটিতে রেখে মন্ত্র পড়তে শুরু করল। আর হাত আবার চলতে চলতে বাড়ির নক্সার কোনে সেই একই জায়গায় গিয়ে থামল। হাত তুলে নিয়ে বাবা জিজ্ঞেস করল,
- শেষ বার কোন ঘরে দেখা গিয়েছিল?
- ওই গোয়াল ঘরের পাশের ঘরটাতে
- এখন তো দেখছি ধারের ঘরটাতে চলে এসেছে
- উপায়?
- একই জায়গায় নেই যখন, একটু বসো আরেকবার দেখি, বেরিয়েও যেতে পারে।
বৃষ্টির ফোঁটার সঙ্গে হালকা হালকা হাওয়া চলতে শুরু করেছে। গাছের পাতার সঙ্গে লণ্ঠনের আলোও অল্প অল্প দুলে উঠছে। মেঘের গর্জন দূরের থেকে এখন বেশ কাছে চলে এসেছে। ঝিঁ ঝিঁ পোকা গুলো একটু করে চেঁচাচ্ছে আবার চুপ করে যাচ্ছে, যেন চেঁচানোর অনুমতি চাইছে, কিংবা নিজেরাই বোঝার চেষ্টা করছে যে চেঁচালে আমাদের কোনো অসুবিধে আছে কিনা। পাশের অশ্বথ্ব গাছের পাতার আওয়াজ জানিয়ে দিচ্ছে, হাওয়া আরো বেড়েছে। মাটির বাড়ির টিনের ছাদ থেকে মাঝে মধ্যেই তবলায় চাঁটি মারার মতো বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটার আওয়াজ আসছে। যেন বলতে চাইছে, প্রকৃতির রুদ্র রূপের জন্য আসর সাজানো সম্পূর্ণ হয়েছে। মেঘের গর্জনের সঙ্গে বিদ্যুতের ঝলকানিতে কপালে ভাঁজ ফেলে অন্ধকার কালো আকাশের দিকে তাকিয়ে বাবা বলল
- এক্ষুনি ঝড় উঠবে মনে হয়। রেডিওটা বন্ধ করে দে
জোরে মেঘ ডাকলে বা ঝড় উঠলে রেডিও বন্ধ করে দেওয়ারই নিয়ম ছিল। বুঝলাম, এক সরীসৃপের দুশ্চিন্তা নিয়ে জগা কাকা যার কাছে এসেছে, সে নিজেও এখন প্রকৃতির এই সম্ভাব্য রুদ্র রূপের জন্যে দুশ্চিন্তায় মগ্ন। হয়তোবা, মাটির দেওয়াল আর টিনের ছাদ এই কালবৈশাখীর দিনে দুশ্চিতাই দেয়।
বেশ কিছুক্ষন পরে মাটিতে আঁকা বাড়ির নক্সার মুছে যাওয়া অংশটা আবার এঁকে নিয়ে বাবা একই ভাবে মাটিতে হাত রাখল। বাকি সব কিছুই আগের মতো, শুধু লণ্ঠনের আলোটা মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে। হাত আবার চলতে শুরু করল। এক পশে আমি আর আরেক পাশে নক্সার বাড়ির মালিক। হাত কচলানো দেখে বোঝা যায়, হাত কোথায় থামে তা দেখার জন্যে উদগ্রীব। হাত আগের মতোই চলতে লাগলো ধারের ঘরের দিকে, ধীরে ধীরে ঘরের কোনার এক অংশ মুছে দিয়ে নক্সা ছেড়ে এগিয়ে গেল। এই প্রথম বার জগা কাকার কপালের ভাঁজ মিলিয়ে গিয়ে চোখদুটো চকচক করে উঠল, যার দৃষ্টি লণ্ঠনের কাঁপা কাঁপা আলোয় মাটির উপর চলতে থাকা বাবার হাতের দিকে, হয়তোবা একই জিনিসের পুনরাবৃত্তি দেখার আশায়। এক সরীসৃপের আগমনে তার মনে যে দুশ্চিন্তার কালবৈশাখী তৈরী হয়েছে তা বোধহয় কাটতে চলেছে। আমাদের মাথার উপর মেঘের গর্জন আরো বেড়েছে তার সঙ্গে বেড়েছে হওয়ার তেজ, পাল্লা দিয়ে বেড়েছে লণ্ঠনের আলোর কাঁপুনি।
বাবার হাত আবার চলতে শুরু করল, লণ্ঠনের কাঁপা আলোকে ঠেলে সরিয়ে, মাটিতে আঁকা নক্সার এক কোনা মুছে দিয়ে হাত এগিয়ে গেলো একদম সামনে। বাবা একটু সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে, কারণ হাত নক্সা ছাড়িয়ে এগিয়ে গেছে। কাঁপা আলোয় বাবার হাতের লম্বা ছায়া ঠিক যেন সরীসৃপের মতোই মাটিতে বসা জগা কাকার সামনে দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে অন্ধকারের দিকে চলে গেলো। হাত ফিরিয়ে এনে নক্সা মুছতে মুছতে বাবা বলল
- বেরিয়ে গেছে, আর ভয় নাই
- বাঁচালে, নাহলে এই ঝড় বৃষ্টি মাথায় করে রাতের বেলায় কোথায় যে যেতাম
হওয়ার দাপটে লন্ঠন এবার প্রায় জবাব দিতে চলেছে। আসন্ন কালবৈশাখী মাথায় নিয়ে প্রায় নিশ্চিন্তেই জগা কাকা বিদায় নিয়েছে। আমিও ফিরে এসেছি বারান্দায়, পাটিগণিত গুটিয়ে আবার সেখান থেকে ঘরে, কারণ হাওয়া এখন ঝড়ের রূপ নিয়েছে। বাবা হাতের আড়াল দিয়ে ছোট্ট লন্ঠন টাকে বারান্দায় রেখে মাটির বারান্দার ছাউনির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কি যেন বলতে লাগল। না এ কোনো সরীসৃপ তাড়ানোর মন্ত্র নয়, এ প্রাকৃতিক দুর্যোগের দুশ্চিন্তার বহিঃপ্রকাশ।
এক অযাচিত সরীসৃপকে কারো বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার রাস্তা দেখিয়ে, হাত এখন মাটি ছেড়ে বারান্দার ছাদে। নিচে থেকেই পোড়া মাটির ছাউনি সরিয়ে বারান্দায় জল পরা আটকাচ্ছে। কাল আবার হয়তো অন্য কারো বাড়ির নক্সার উপর দিয়ে চলে তার দুশ্চিন্তা মেটাবে।
************************************
Comments
Post a Comment