গঙ্গা ফড়িং



২৩ শে জুন ১৭৫৭, পলাশীর আমবাগান সবেমাত্র পলাশীর যুদ্ধ শুরু হয়েছে ণবাব সিরাজের নেতৃত্বে পঞ্চাশ হাজার সৈন যুদ্ধে নিজেদের প্রাণ দেওয়ার জন্যে প্রস্তুতআর উল্টোদিকে কর্নেল রবার্ট ক্লাইভ এর কাছে মেরে কেটে সাড়ে সাতশ থেকে হাজার সৈন  তাও ইংরেজ ও ভারতীয় সিপাই মিলেক্লাইভের ইংরেজি হুংকারের প্রত্যুতারে সবে মাত্র নবাব হাতে তলোয়ার নিয়ে একটা গম্ভীর হুংকার ছেড়েছেন হঠাৎ একটা  গঙ্গা ফড়িং এসে সোজা নবাব সিরাজের নাকের উপরে বসল এতবড় স্পর্ধা , যুদ্ধের ময়দানে নাবাবের নাকে গঙ্গা ফড়িংসেটা মোটেও সহ্য হলোনাবাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাব সিরাজউদ্দৌলা কিনা নাকের উপর গঙ্গা ফড়িং নিয়ে যুদ্ধ করবেনআর কি, গঙ্গা ফড়িংটাকে নাবাবের নাক থেকে তুলে সোজা কেরসিনের আলোর কাঁচে চেপে ধরতে যাব  কি, মাথার পিছনে   এক চাঁটিচমকে উঠে ভাবলাম, -একি  যুদ্ধ তো আমার ইতিহাস বইয়ের পাতায় চলছে তাহলে.....বুঝলাম মা আমাদের পিছনে শুয়ে শুয়ে সব কিছু দেখছিল, -তোর এটা কি পড়া হচ্ছে?

-        --না, পড়ছিলাম তো , একটা গঙ্গা ফড়িং এসে বই এর সিরাজের ছবির উপর বসে পড়ল

যাই হোক মাএর চাঁটি খেয়ে অগত্যা আবার যুদ্ধ শুরু করতে হলো।

গ্রামে তখন ইলেকট্রিসিটি ছিল নাসন্ধ্যের পরে কেরসিনের আলোই ছিল আমাদের কাছে একমাত্র  উজ্জল জ্যোতিষ্কসেই কেরোসিনের আলোকে   গোল করে ঘিরে বসে আমরা ভাই বোনেরা  প্রতি সন্ধ্যায় বাড়ির বারান্দায় পড়াশুনা করতামসেই আলো শুধু আমাদের ওই  কজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত । আর বাকি জায়গাটা মনে হত  যেন সূর্যের থেকে কয়েক আলোকবর্ষ দূরে যেখানে শুধুই ঘন অন্ধকার ওই জমাট অন্ধকারের মাঝে কখনও কখনও ধূমকেতু বা  উল্কার মতো জোনাকির দেখা মিলত । কেরসিনের লণ্ঠনের দুই দিকে দুটো খুঁটির মতো থাকত, যার ভিতরে লণ্ঠনের কাঁচ লাগানো হতো। সেই খুঁটির ছায়া লম্বা হয়ে লণ্ঠনের ঠিক দুদিকে পড়ত। লন্ঠন ঘোড়ালে সেই ছায়াও ঘুরত। সেই ছায়া কার দিকে থাকবে তাই নিয়ে মাঝে মাঝে আমাদের মধ্যে ছোট খাটো ছায়া  যুদ্ধ বেঁধে যেত। পরে বাবা কিংবা মায়ের মধ্যস্থতায় এসে সেই যুদ্ধ থেমে আবার সন্ধি হত।

আমাদের পড়ার মাঝে প্রায় ই কিছু আগুনতূক এর আগমন হতো । কিছু পোকা মাকড়, গঙ্গা ফড়িং ও দু একটা  ব্যাঙকিছু ঝিঁঝিঁ পোকা তারস্বরে চিৎকার করে আমাদের পড়া গোল্লায় পাঠাত, পড়ার থেকে ঝিঁঝিঁ পোকাতে তখন উৎসাহ বেশি জীবন বিজ্ঞানের বইতে পড়া ব্যাঙ এর উল্টানো জিভ বাইরে ছুঁড়ে দিয়ে খাবার খাওয়া, পড়তে পড়তেই চোখের সামনে দেখতে পেতাম যখন ব্যাঙ বাবাজী এসে আমাদের আলোর চারপাশের পোকা মাকড় খেয়ে ডিনার সারত।  পড়তে পড়তে উপরের দিকে  তাকালে চাঁদ তারা সহ  পুরো আকাশগঙ্গাই দেখা যেতযখন ভূগোল পড়তাম মনে হতো, যেন পড়ার সঙ্গে সঙ্গে লাইভ ডেমো চলছে মাথার উপরেবাবা পাশেই বসে খবরের কাগজ পড়তরেডিওতে শুনতাম ওই কাগজটা নাকি ভগবান ছাড়া কাউকে ভয় পায়  নামনে মনে ভাবতাম, বাপরে আমাদের স্কূল এর দুর্যোধন বাবু বা কালী বাবু কেও ভয় পায়না? কি কাগজমাঝে মাঝে বাবাকে জিজ্ঞেস করতাম,

-       - বাবা, আচ্ছা ধ্রুব তারা কি সবসময় উত্তর দিকেই থাকে?

-        -হ্যাঁ, উত্তরদিকেই থাকেদেখে আয়

সঙ্গে সঙ্গে গঙ্গা ফড়িং এর মতোই একলাফে বাড়ির বারান্দা থেকে উঠোনে নেমে চারিদিকে মথাটা চরকির মতো ঘুরিয়ে তাঁকে খুঁজতাম কিন্তু উত্তর দিকটাই  দেখতাম নাকারণ বাড়ির ভিতর থেকে উত্তর আকাশ পুরোটা দেখা যেত নামা বলত,

-        --এই গাধা, উত্তর দিক দেখতে হলে তো তোকে বাড়ির বাইরে যেতে হবে

-       -- ওহ, তাহলে থাক, ধ্রুব তারা কালকে সকালে দেখে নেব

-        --হ্যাঁ, কাল সকাল পর্যন্ত সে তোর  জন্যে ঐখানে বসে থাকবে।

কারণ রাতের অন্ধকারে বাড়ির বাইরে যাওয়ায় সৎ  বা অসৎ  কোনো সাহসই আমার ছিল না। আমার সঙ্গে অন্য কেউ যদি ওই গঙ্গা ফড়িং হয়ে ধ্রুব তারা দেখতে নামত, বাবা বলত

-        ---এই, তোর  অঙ্কের মধ্যে কোথায় এখন ধ্রুব তারা এল ?

--অগত্যা সে পুনরায় গঙ্গা ফড়িং হয়ে ব্যাক টু  বারান্দা।

অন্ধকারের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে   মাঝে মাঝে কুকুর শেয়াল তাদের উপস্থিতি জানতশেয়াল গুলো সাধারনত শীতকালেই হল্লা বেশি করতআর বাকি  সময় কুকর আর পেঁচা ই ছিল রাতের একমাত্র সঙ্গী, মানে হতো আমরা একা নই, ওরাও আছে। রাতের কিছু কিছু সময় পেঁচা পাখিরা একসাথে ডেকে উঠত, মা বলত রাত একপ্রহর হয়ে গেলবুঝতাম না, ওরা ঘড়ি  ছাড়া বোঝে  কি করে যে ক প্রহর হলোমা বলত,

-        --পশু পাখিরা সব কিছু আমাদের থেকে অনেক বেশি আর অনেক ভালো করে বুঝতে পারে।

আর আমাদেরকে মাঝে মাঝে বলত,  --তোর  মতো গাধা আর দুনিয়ায় দুটো নাই। আর কবে বুদ্ধি সুদ্ধি হবে ।

বুঝতাম, পশুপাখিদের মধ্যে গাধা সবথেকে বোকা আর আমি বোধহয় তার থেকেও। কারণ আমার মতো গাধা এই দুনিয়ায় একমাত্র আমিই। মনে মনে ভাবতাম, তাড়াতাড়ি বড় হতে হবে, বেশিদিন আর গাধা থাকা  ঠিক হবে না।

কয়েক ঘণ্টা আগেই বিকেলে যে কুকুরটার লেজে প্লাস্টিক জড়িয়ে তার সাথে খেলা করছিলাম, এখন রাতের বেলায় বন্ধ দরজার ঐপার থেকে তারই একটু বেসুরো আওয়াজ যেন মনে হয় কোনো রহস্যময় ভয়ংকর প্রাণী আমাদের দরজার উল্টোদিকে বসে আছেবাইরে বেরলে এখনই চেটে সাবাড় করে দেবে। যে জায়গাটায় পাড়ার সব বন্ধুদের সাথে সারাদিন খেলতাম, অন্ধকার নামার পর সেই জায়গাটাকে মনে হতো কোটি কোটি ভূতের আস্তানাবাবা বলত, 

-        --অনেক দিন আগে ঐখানে যখন যাত্রাগান হতো, রাতের বেলা ভূতেরা দল বেঁধে যাত্রাগান শুনতে আসতআসে পাশের বাঁশ গাছগুলো তেনাদের ভারে নুয়ে পড়ত। আবার যাত্রাগান শেষ হয়ে গেলে সব্বাই একসাথে ছোট খাটো  একটা ঝড় তুলে সেখান থেকে চলে যেত। বাঁশ গাছ আবার সোজা। আবার যাত্রাগান তেনাদের পছন্দ না হলে শুনিয়ে যেত “এঁবারের তাঁ ভাঁলো হঁয়নি। শুঁধু শুঁধু সঁময় নষ্ট হোঁল “

ভাবতাম, ভূতেদেরও না জানি কত কাজ? এখনও কতজন কে ভয় দেখানো বাকি কে জানে?

রাতের অন্ধকারে হঠাৎ হঠাৎ বাড়ির বাইরের রাস্তা থেক গুনগুন গান বা কাশির আওয়াজ পাওয়া যেত, বুঝতাম কেউ রাস্তা দিয়ে বিনা  আলোতে হেঁটে বা সাইকেলে যাচ্ছেআবার একা গলায় রাম নাম বা কীর্তন শোনা গেলে বুঝতাম আমারই মতো কেউ ভয় পেয়েছে তাই রাম নাম বেরোচ্ছে। একটু বেশি রাত হলে, সেই গুণ গুণের জবাবে বাবা বাড়ির ভিতর থেকেই মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করত, -কে রে ?

-        --দাদা, আমি গো ।

-       -- 

বাবা ওই আমিগো কে গলার আওয়াজ এ চিনে নিয়ে নিশ্চিন্ত হতো । ভাবতাম, সারা দুনিয়াই তো আমিগো।  তাছাড়া এই কাঠের উনানে রান্না করা ভাতের হাঁড়ির পিছনের কুচকুচে কালো কালির মতো জমাট  বাঁধা অন্ধকারে শুধু আমিগো তে সন্তুষ্ট হওয়া কি ঠিক? যাত্রাগান শুনে অসন্তুষ্ট হওয়া তেঁনারাও তো হতে পারেন? যাই হোক কোনদিনই ওই আমিগো কে নিয়ে কোনো সমস্যা কিন্তু হয়নি।

গরমের দিনে একটা সময়  চাষের ক্ষেত গুলো মোটামুটি খালি থাকত, আর সারা মাঠ জুড়ে গরুর পাল চড়ে বেরাত । শিরীষ গাছের পাক ফল গরমের রোদে ফেটে গিয়ে এমন এক আকার নিতো, যখন উঁচু গাছের ডাল থেকে খসে পড়ত, হওয়ায় নিজে নিজেই সুন্দর ঘুরপাক খেতে খেতে মাটিতে এসে পড়ত। ফেটে যাওয়া শিমুল ফলের থেকে বীজ শুদ্ধ তুলো হওয়ায় ভাসতে ভাসতে সারা পাড়া ছড়িয়ে পড়ত। হওয়ায় উড়তে থাকা  ফড়িং ধরে তাকে জোর করে কচু পাতার রস খাওয়াতাম, তারপর আবার ছেড়ে দিতাম। দেখতাম সে কতটা উড়তে পারে। সে যেন এক পরীক্ষা নিরীক্ষা, যে কচু গাছের রসে ফড়িং এর শক্তি কতটা বাড়ে।

সন্ধ্যের ঠিক আগে প্রায় রোজই যেন ঘোড়া দৌড়ানোর আওয়াজ পাওয়া যেত। তাড়াতাড়ি বাড়ির দরজা দিয়ে মাঠের দিকে উঁকি দিয়ে দেখতাম, পাঁচ ছটা গরু চার পা শূন্যে তুলে লেজ উঁচিয়ে ছুটে আসছে। ঠিক যেন অশ্বমেধের ঘোড়া, না না মানে অশ্বমেধের গরু সারা পাড়া জয় করতে বেরিয়েছে।  মাঠ থেকে পাড়ায়  ঢোকার আগে একটা বড় পুকুর, সবকটা গরু একসঙ্গে সেই পুকুরে নেমে সামনের দুটি পা হাঁটু পর্যন্ত জলে ডুবিয়ে এক নিশ্বাসে পেটভরে যতটা পারত জল খেয়ে নিত আর তারপরে সবাই একসঙ্গে ফোঁ-ও-ও-স করে জলের উপর নিশ্বাস ছারত  তাতে জলের উপর তৈরি ঢেউ পুকুরে ছড়িয়ে পড়ত জলের মাঝে অলস ভাবে বসে থাকা হাঁস গুলো  সেই ঢেউয়ে বিনা  পরিশ্রমে দোলা খেতগরুর দল তারপর পুকুর থেকে উঠে গতি কমিয়ে হেলতে দুলতে যে যার নিজের নিজের বাড়ির দিকে চলতে থাকত। যেন অশ্বমেধের গরু রণে ভঙ্গ দিয়েছে।

ভরা বর্ষায় পুকুর, মাঠ ও ধান ক্ষেত সব মিলে মিশে একাকারযেদিকে যতদূর নজর যায় সেদিকেই জলকিছু কিছু মাছ  রাস্তায় জমা অল্প জলের উপর  দিয়ে মনের আনন্দে নাচতে নাচতে এক পুকুর  থেকে অন্য পুকুরে চলেছেকোনো কোনো মাছের  কপাল খারাপ থাকলে,  তার সঙ্গে মানব জাতির কোনো সদস্যের দেখা হয়ে যেতজল জমলেই সাদা বকের মেলা  লাগতঅবাক হয়ে ভাবতাম আমাদের এখানে শুধু অলস খোঁড়া বক গুলোই কেন আসেযাদের শুধু একটাই পা আর সবসময় চুপচাপ বসে থাকেওরা কি মাছ ধরার ছিপ ফেলে বসে থাকে? মাছরাঙ্গা গুলো জলের কাছে খুব নিচু ডালে  বসে একভাবে জলের দিকে তাকিয়ে ধ্যান করত। কোনো মাছ যদি জলের উপরের দিকে এসে উর্বশী বা রম্ভা হয়ে তার ধ্যান ভঙ্গ করার চেষ্টা করে, মাছরাঙ্গা তখনই  তাকে সঠিক শাস্তি দিয়ে দিত।

 হঠাৎ গরু ছাগলের একসঙ্গে তারস্বরে চিৎকার শুনে বোঝা যেত, বৃষ্টি নেমেছে। আর আমরাও খেলতে খেলতে দৌড়ে গিয়ে মানকচু  গাছের বড় বড় পাতার তলায় লুকিয়ে পড়তাম। বৃষ্টি যতক্ষণ না খুব জোরে আসছে বা বৃষ্টির মধ্যে মা জননী হাতে লাঠি নিয়ে বেরোচ্ছেন ততক্ষণ ঐখানেই।

বর্ষার জলে টইটুম্বুর পুকুরের একদম উল্টো পারে যেখানে কারও পক্ষে যাওয়া প্রায় অসাধ্য, সেইখানে সন্ধের ঠিক আগে প্রায় রোজই এক বিরাট মিটিং বসত। যেন, আজকে কে কি করল, আর কালকের কি প্লানিং তাই নিয়ে বিশাল আলোচনা চেঁচামেচি।  সেই মিটিং এর মাঝে কখনও কখনও  বিপক্ষের কিছু প্রতিনিধি সেখানে হামলা করত যেমন, বনবিড়াল, শেয়াল বা তাদেরই কোনো ঊর্ধ্বতন আত্মীয়। পাড়ার হাঁসেদের ওই মিটিং এ তারা মাঝে মাঝেই ঝাঁপিয়ে পড়ত। বিড়াল বা শেয়ালের হানা দেওয়ার আগেই তাদের কে সেখান থেকে তাড়িয়ে বাড়ি  নিয়ে আসা একটা রোজের দক্ষ যজ্ঞ ছিল। কোনো কোনো হাঁস, যারা একটু নেতা গোছের, তারা আসতেই চাইত না । একদিকে তাড়া দিলে অন্য দিকে চলে যেত। ভাবটা এমন যেন এখন ও অনেক জরুরী আলোচনা বাকি। কেউ কেউ তো আবার অন্ধকার নেমে আসার পরেও পুকুরের ঠিক মাঝখানে চুপচাপ বসে থাকত। ঠিক যেন ভগবান ব্রহ্মার তপস্যায় মগ্ন, দেখা না পাওয়া পর্যন্ত কোথাও যাওয়া নয়।  

মাঝে মাঝে রাতের বেলা পুকুরের দিক থেকে হাঁস তাড়ানোর আওয়াজ পাওয়া যেত, বুঝতে হতো, কারো বাড়ির হাঁস হয় শেয়ালের ডিনার টেবিলে পৌঁছে গেছে নয়ত এখনও পুকুরের জলের মাঝখানে চুপচাপ বসে চাঁদের আলোয় ভগবান ব্রহ্মার আশীর্বাদের অপেক্ষা করছে।  

শীতের সকালে পুকুরের জলের দিকে তাকিয়ে কিছুতেই মাথায় ঢুকত না, এই হাড় হিম করা ঠাণ্ডাতেও পুকুরের জল এতো গরম হলো কিকরে, যে তার থেকে গরম ভাপ উঠছে। একটু বেশি জিজ্ঞাসু হয়ে নিচে নেমে মাঝে মাঝে জলে হাত ঠেকিয়ে দেখলে  বুঝতাম, মা ঠিকই বলে, আমি ই দুনিয়ার এক নম্বর গাধা। যাই হোক, শীতের সকালে খেঁজুর গাছের নিচে দাঁড়িয়ে সদ্য ওঠা রবি মামার চোখে চোখ মিলিয়ে হাঁ করে মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে বেশ মজা লাগত। মানে হতো পেটে  আগুন লেগেছে। হঠাৎ কানে হ্যাঁচকা টান পড়লে বুঝতাম, ধোঁয়া একটু বেশি বেরিয়ে গেছে তাই পড়তে বসার  কথা ভুলে গেছি। শীতের সন্ধ্যেটা যেন বড্ড তাড়াতাড়ি নামত। বাড়ির রান্নার উনানের  ধোঁয়া  কেমন যেন খুব নিচু হয়ে চারিদিকে লাইন করে ছড়িয়ে থাকত, যেন তারা আর উপরে উঠতে চায় না।  বাঁশ বাগানে পাখিদের মেলা বসে যেত, ভীষন চিৎকার চেঁচামেচি মনে হত  দুনিয়ার সমস্ত পাখি আমাদের এই বাঁশ বাগানেই থাকে। সেই চিৎকার তাদের ঝগড়া নাকি সারাদিন পরে ঘরে ফিরে পাড়া প্রতিবেশীর সঙ্গে কথা বলা বুঝতে পারতাম না। 

এরই মাঝে কখন যেন কেউ আকাশে নীল রং ঢেলে তার ওপরে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ ছেড়ে দিত। বুঝতাম তাঁর আসার সময় হয়ে গেছে। তাই প্রকৃতিও যেন নিজেকে তার জন্যে সাজিয়ে নিচ্ছে। ঘন সবুজ ধনক্ষেতের উপর দিয়ে হওয়া যেন  মাতালের মতো নেচে নেচে চলেছে। সমস্ত মাঠ সবুজ কিন্তু তাতেই কত বৈচিত্র, কোনোখানটা  গাঢ় সবুজ, কোনোখানটা হালকা সবুজ আবার কোনোখানটায় সবুজের সঙ্গে অল্প হলুদের আভা । ঠিক যেন কোনোটায় রং একটু বেশি আর কোথাও একটু কম পরে গেছে। দূরে কাশ ফুলের মেলা, আর সেখানে লেজ চিরে যাওয়া ফিঙে পাখিগুলো এমন ভাবে তার চারপাশে উড়ে বেরাত, যেন সব কাশফুল ওদেরই।

বর্ষা সদ্যই বিদায় নিয়েছে। তাই চারপাশের পুকুর এখনও যেন আর্কিমিডিসের জল ভরা কুঁয়ো। কুলের পুকুর আর বাঁশের পুকুর এর মাঝের রাস্তা জলের তলায়, কূলে বংশে মিলে মিশে একাকার। ভাবতাম, মা দুর্গা যদি আসবেন তো আসবেন কোনটা দিয়ে, সব রাস্তাই প্রায় জলে ডোবা । যাই হোক, তিনি কিন্তু আসতেন, প্রত্যেক বছর। বাবা বলত, মা এবারে দোলায় আসছেন, এবারে নৌকায় বা এবারে হাতিতে। কিন্তু প্রত্যেক বারেই পুজো মণ্ডপে গিয়ে দেখতাম সেই সিংহ। মনে হতো, যারা ঠাকুর তৈরি করে, তারা এতো বড় ভুল করলো কিকরে। ঠাকুর এল হাতিতে চড়ে আর এরা কিনা করেছে সিংহ।  

বিজয়ার দিন সে আরেক কান্ড। সারা পাড়ার সবাই সবাইকে প্রণাম করত। মানে, ছোটরা বড়দের। পাড়ার যে কাকা কাকিমা কে তাদের বাড়িতে গিয়ে প্রণাম করে নারকেল নাড়ু খেয়ে আসতাম, তারাই আবার একটু পরে আমাদের বাড়িতে এসে বাবা কে বা মা কে  প্রণাম করে যেত। গঙ্গা ফড়িং হয়ে সেদিন শুধু পাড়ার এই বাড়ি আর ওই বাড়ি করে বেরতম। তখন মনে হতো, বড়দের বেশ মজা। শুধু পা দুটো বের করে এক থালা  নারকেল নাড়ু নিয়ে বসে থাক। ঢিপঢাপ প্রণাম নাও আর নাড়ু দাও।

আর এতদিন পরে যখন একটু বড় হলাম  বুঝলাম, প্রণাম নিয়ে নাড়ু দেওয়াটা কত কঠিন। তার থেকে প্রণাম করে হাত পেতে নাড়ু নেওয়াটা বোধহয় অনেক সহজ। তখন একটা গঙ্গা ফড়িং বইএর পাতায় বসলে, তাকে  নিয়ে কত পরিকল্পনা করতাম, আর এখন তো নিজের চিন্তা ভাবনা গুলোই মাথার মধ্যে গঙ্গা ফড়িং হয়ে সর্বক্ষণ ধেই ধেই করে নাচা নাচি করে, তাও কিছু করার নাই। যতই প্রাণায়াম ধ্যান করো, এই গঙ্গা ফড়িং এর থেকে মুক্তি নাই।

ধ্রুব তারার নাম শুনলেই একসময় তাকে  দেখার জন্যে নিজেই গঙ্গাফড়িং  হয়ে যেতাম, এখন সারা রাত খোলা আকাশের নিচে  ঘুরে বেড়ালেও তাকে দেখতে ইচ্ছে করে না। মনে হয় আছে তো ঐখানেই। রাতের বেলায় ডাকার জন্যে হয়ত শেয়াল কুকুরের সংখ্যাও কম হয়ে গেছে, নাহলে তারাও হয়তো বা, আমাদের মতো সভ্য হয়ে রাতের বেলা চেঁচামেচি করা ছেড়ে দিয়েছে। রাতের প্রহর গুনতে থাকা  পেঁচা পাখিরাও জানে এখন ঘড়ি সবার কাছেই আছে তাই শুধু শুধু রাতভর হল্লা করে লাভ নাই। এখন আর লোকে রাতের বেলা যেতে যেতে আমিগো বলে না। কারণ, কে রে? জিজ্ঞেস করার লোকই তো এখন আর নাই। আর ভূত? যাত্রাগান হলে তবে তো তাঁরা আসবেন।  

দশমীর দিনে খবরের কাগজে বা রেডিওতে শুনতাম, আজও শুনি, আজ বাঙালির মন খারাপের দিন। আকাশে বাতাসে বিষন্নতার সুর। কিন্তু আমি কিছুতেই বুঝতাম  না যদি এতই মন খারাপ তাহলে বাঙালি বিসর্জনের  এর সময় মনের আনন্দে এতো নাচে কেন? অবশ্যই খুশি হয় বলে। যাদেরকেই দেখি হিন্দি গানের তালে তালে ওই গঙ্গা ফড়িং এর মতো তিড়িং বিড়িং করে সিনেমার নায়ক হওয়ার অক্লান্ত ও ব্যার্থ চেষ্টা করে চলেছে। যেন এটাকে জলে ফেলাতেই যত আনন্দ। কই, যদি মা দুর্গা আসাতে  এতই খুশি তো  পঞ্চমী বা ষষ্ঠীর তো দিনে খুব একটা কাউকে নাচতে দেখিনা? মনে হয় আজকের বাঙালি মা দুর্গার পুজো নয়, শুধু বিসর্জনের আশাতেই বসে থাকে।

প্রত্যেক বছর হয়তো সময় মেনে  দুর্গাপূজো হয়, কিন্তু নিয়ম মেনে  বোধহয় আর হয় না। তাই মা দুর্গাও আর প্রত্যেক মণ্ডপে মণ্ডপে আগের মতো বোধহয় আসেন না, ওই কৈলাসে বসেই একটু হাত তুলে আশীর্বাদ করে  দেন। আর আমাদের মন তাতেই গঙ্গাফড়িং হয়ে তিড়িং বিড়িং করে নেচে ওঠে ।

                                               *************************

Comments

Popular posts from this blog

নিত্য যাত্রী

হাত