নিত্য যাত্রী

 

নিত্য যাত্রী

আর কারও ঠকবার ইচ্ছা আছে নাকি? আশি থেকে নিরানব্বই। 

আওয়াজটা নিত্যর  খুব চেনা। প্রায় রোজই অফিস থেকে ফেরার সময় ভিড় লোকাল ট্রেনে এক বৃদ্ধ হাতে একটা বড় কাঁচের বোতল নিয়ে লজেন্স বিক্রি করে। প্রথম প্রথম নিত্য   বুঝতে পারত না যে লজেন্স বিক্রির সঙ্গে আশি থেকে নিরানব্বই পর্যন্ত ঠকার কি সম্পর্ক। তবে কয়েকদিনের মধ্যেই বুঝতে পারলো যে ওই লোকটি উনিশশ  আশি থেকে এই উনিশশ  নিরানব্বই পর্যন্ত এইভাবে লজেন্স বিক্রি করছে, মানে যাত্রীদের ঠকিয়ে আসছেসারাদিন অফিসে পরিশ্রম করার পর ফেরার পথে এই ভিড় ট্রেনে ক্লান্ত শরীরে ঠকতে খুব একটা খারাপ লাগে না

 নিত্য মজুমদারের মতো সমস্ত নিত্য যাত্রীদের কাছে এরা একরকমের আত্মীয়ের মতো। অফিসের কেউ খোঁজ  করুক বা না করুক, এরা দেখা হলেই কিন্তু কুশল বিনিময় করতে দ্বিধা করে  না। তা সে ঠকুক বা না ঠকুক। এরইমধ্যে পিছনের গেটের দিক থেকে আওয়াজ আসে, - A ফর আপেল B ফর বল, আজকের আপেল না খেলে দিনটাই বিফল। চ্যাটার্জীদা তার ছোট্ট জলের বোতল মুখে তুলতে তুলতে বলে ওঠেন, -   ওই A ফর আপেল, এক কিলো দিও

ফেরিওয়ালা তার ঝুড়িতে ফল থাকা  সত্বেও ঠোঁটের কোণে একটুকরো হাসি নিয়ে বলে ওঠে, 

-   চ্যাটার্জী দা, আজকে নাই। কালকে নেবেন।

আর এটুকুটেই দুই পক্ষই সন্তুষ্টির হাসি বিনিময় করে চোখের ঈশারায় একে অপরকে বুঝিয়ে দেয় যে আজকের ফল খুব একটা ভালো না, আর অন্যদিকে চ্যাটার্জীদাও বুঝিয়ে দেন, ঠিক আছে আমার কালকে নিলেও হবে। আবার পরের দিন আর তাকে বলতে হয়না, নিজে থেকেই A ফর আপেল ওজন করে প্যাকেটে ভরে চ্যাটার্জী দার হাতে ধরিয়ে দিয়ে যায়। একইরকম ভাবে পেনের রিফিল বিক্রি করতে আসা গাভাস্কর, জানালার পাশে বসা অফিস ফেরত ক্লান্ত ঘুমন্ত সেন বাবুর উদ্দেশ্যে বলে ওঠে, 

-   সেনদা, উঠে পড়ুন নামতে হবে।

-   ও হ্যাঁ, ঠান্ডা হাওয়ায় চোখ লেগেগেছিল।

পুরো ট্রেনের নিত্যযাত্রীরা নিপাট বাঙালি এই ফেরিওয়ালাকে গাভাস্কর নামেই চেনে আর এই ভূভারতে বোধহয় এমন কোনো পেন নাই, যার রিফিল গাভাস্করের কাছে পাওয়া যাবে না। সত্যিই ইনি গাভাস্করের মতোই কিংবদন্তি। লৌহ নির্মিত চলমান এই বাড়িটার প্রত্যেকটা ঘরের বাসিন্দাদের মতো এরাও এই বাড়িরই সদস্য, যাদের নির্দিষ্ট কোনো ঘর এই চলন্ত বাড়িটাতে নাই ঠিকই কিন্তু সব ঘরেই তাদের অবাধ যাওয়া আসা।

ট্রেন একটা স্টেশন ছাড়তেই, কেউ যেন দূর থেকে আজকের সারাদিনের বিশেষ বিশেষ  সব খবরগুলো   এক নিশ্বাসে বলে গেল। এ আর কেউ না, আরেক আত্মীয়, শ্রীমান শিরোনাম। বাম দিকের কাঁধের উপর শখানেক বিভিন্ন রকমের খবরের কাগজ নিয়ে ট্রেনে ট্রেনে খবর বিক্রি করে বেড়ায়। সমস্ত কাগজের সমস্ত শিরোনামই যেন তার কণ্ঠস্থ আর সেখান থেকেই বোধহয় তার এই নামরকম। তবে এই শ্রীমানের চাহিদা সন্ধ্যাবেলা এতই বেশি হয় যে সে নিজেও মাঝে মাঝে সামলাতে পারে না। তার একমাত্র  কারণ সন্ধ্যা বেলা সে সারাদিনের সমস্ত খবরের সংক্ষিপ্তসার ট্রেনের কামরায় কামরায় ঘুরতে ঘুরতে যাত্রীদের শুনিয়ে দেয়। আর দিনেরই  কোনো শিরোনামের মতোই হয় তার সাজসজ্জা। কামরার একপ্রান্ত থেকে খবর শোনাতে শোনাতে শ্রীমান শিরোনাম এদিকেই  আসছে,

-   পাকিস্তানে পালা বদল, ক্ষমতার দখল  নিল পারভেজ মুশারফ…… নওয়াজ শরীফের ভাগ্য এখন ……..  

হঠাৎ বসাক দার উপর নজর পড়ায় হাসতে হাসতে খবরের শিরোনামের মতো করেই বলতে শুরু করল,

-   এখানে বসাক দা বসে আছেন, একটু আধটু ভুল হলেই চাকরি চলে  যাবে।

জানালার পাশেই সেদিনেরই বর্তমান পত্রিকা হাতে নিয়ে বসা বর্তমানেরই  অফিসে কর্মরত সুদীপ্ত বসাক শ্রীমান কে দেখে একটু মুচকি হাসি বিনিময় করলেন।

এই মে মাসেরই প্রথম সপ্তাহের দিকের ঘটনা, শ্রীমান শিরোনাম আপদ মস্তক ভারতীয় সেনার পোশাকে, মাথার টুপির সঙ্গে দুই কানের পাশ দিয়ে দুটি জাতীয় পতাকা শক্ত করে বাঁধা, আর মুখে দেশাত্মবোধক গানের ফুলঝুরি। তখন কার্গিলের যুদ্ধে ভারত সৈন্য শক্তি বড়াচ্ছে। ঠিক একই রকম ভাবে সেই কার্গিল যুদ্ধের আবহে যেদিন ভারত পাকিস্তানকে ক্রিকেট বিশ্বকাপে হারায়, পরের দিন  সন্ধ্যায় পুরো দস্তুর ভারতীয় ক্রিকেট টিমের পোশাকে এক কাঁধে একটা ক্রিকেট ব্যাট আর অন্য কাঁধে  এক বড়সড় প্লাস্টিকের রাইফেল নিয়ে এই শ্রীমান শিরোনামের খবর বিক্রি যারা যারা দেখেছিল, তা তারা কোনদিন ভুলতে পারবে কিনা সন্দেহ।

   দুটো স্টেশন পরেই নিত্যকে নামতে হবে তাই এখন থেকেই একটু একটু  করে ট্রেনের দরজার দিকে আগিয়ে যাওয়াই ভালো। ট্রেন ইতিমধ্যেই শহর ও মফস্বলের ব্যস্ততা ছড়িয়ে গ্রামের শান্ত জমাটবাঁধা অন্ধকারে প্রবেশ করেছে। ট্রেনের মধ্যে ভিড় যথেষ্ট হলেও, এখানে স্টেশনগুলোতে ওঠা নামার লোকজন যথেষ্ট কমওঠা নামার লোকজনও যেমন কম তাদের ব্যস্ততাও তেমনই কম। দু তিনটে স্টেশন আগে যে লোকটাকে দেখে ভীষন ব্যস্ত ও বিরক্ত মনে হচ্ছিল, সেই লোকটাই এখন কত শান্ত ও খুশি। হয় নিজের মনে খবরের কাগজের বেশ কয়েকবার পরে ফেলা খবরেই চোখ বোলাচ্ছে নয়তোবা শান্ত দৃষ্টিতে ট্রেনের জানালার বাইরে তাকিয়ে হাওয়ার আদুরে চড় থাপ্পড় খেতে খেতে অন্ধকারের সৌন্দর্য উপভোগ করছে

 রাজ্য সরকারের পূর্ত বিভাগে কর্মরত সৈকত তথা মামা  ইতিমধ্যেই খবরের কাগজের শব্দ ছক নিয়ে বসে পড়েছে। হাতের কাছে কলম না পেয়ে তিন জনের বসার জায়গায় চতুর্থ স্থানে বসা অর্ধ ঘুমন্ত অর্ধ ঝুলন্ত সান্যালদার  পকেট থেকে কলমটা হ্যাঁচকা মেরে নিয়ে শব্দ ছকে মন দিল। আর সেই হ্যাঁচকা খেয়ে সান্যালদা  পিছন দিকে হেলীয়ে দেওয়া ঘাড়টা সোজা করে মামার  দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হেসে আবার তন্দ্রার দুনিয়ায় ফিরে গেলেন। আর মামাও ট্রেনের দুলুনির সঙ্গে নিজের শরীর টাকে মিলিয়ে দিয়ে ডান দিকে বাম দিকে হেলতে দুলতে নিজের মনের অভিধানে ডুব দিল। ভিড় একটু হালকা হতেই, পাশের সারিতে বসা সনাতনদা তার কালো চারকোনা ব্যাগের থেকে তাসের বান্ডিল বেরকরে ফেলেছেন। একটা লাল কাপড় সামনা সামনি বসা চারজনে মিলে ধরে তাতেই শুরু হয়েছে টেক্কা সাহেব গোলাম বিবির কেরামতি।

 রাতের শহর-মফস্বল ছড়িয়ে আসা চলন্ত ট্রেনের ভিতর থেকে দেখা  জানালার বাইরের অন্ধকার জগতটা যেন এক অদ্ভুত দুনিয়া। মাঝে মাঝে একটা করে ছোট ছোট স্টেশন আসে আর তারপর আবার ঘন অন্ধকার। শুধুমাত্র কিছুক্ষণ ছাড়া ছাড়া  প্যান্টোগ্রাফে তৈরী হওয়া সুতীব্র নীল আলোর ঝলকানি।  অনেক দূরের গ্রামের বাড়ির ছোট ছোট আলগুলো যেন শান্ত ধীর পায়ে পিছনের দিকে হাঁটছে। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে কান পাতলে ট্রেনের চাকার আওয়াজের সঙ্গে ঝিঁঝিঁ পোকার গানও কানে আসে। অন্ধকারে পাশ দিয়ে চলে যাওয়া অন্য ট্রেনের ভিতরের আলো জানালা দরজা দিয়ে এমন ভাবে বাইরে আসতে থাকে, তাকালে মনে হয় পুরো ট্রেনটা যেন অশরীরী, শুধুমাত্র জানালা দরজাগুলোই ছুটছে। আর এই অশরীরী ট্রেনেই  কতশত ক্লান্ত শরীর দিনের শেষে নিজের নিজের আস্তানার  দিকে ছুটে চলেছে, শুধুমাত্র রাত কাটানোর তাগিদে।

দাঁড়িয়ে থাকা  যাত্রীদের অনকেই বসার জায়গা পেয়ে একটু আরাম করে নিচ্ছে, আর কামরার উপরে লাগানো দাঁড়ানো-যাত্রীদের ধরার হাতলগুলো অবসর পেয়ে ট্রেনের গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সমবেত ভাবে সুন্দর ছন্দে এক অদ্ভুত আওয়াজ করে ডান-বাম অথবা আগে-পিছে দুলে চলেছে। এক হাতে ঝোলানো উনানের উপর মুখে লম্বা কাগজের ছিপি লাগানো  কেটলি ভর্তি চা আর অন্য হাতে বালতি ভর্তি মাটির ভাঁড়, বিস্কুট নিয়ে রহমানের আবির্ভাব,

-   লাল দুধ কালো লেবু স্পেশা………..। চাচার চাঃ 

স্পেশাল টা বেশ অনেকটা টেনে বলে রহমান আর শেষে ছোট্ট করে আস্তে করে জুড়ে দেয় চাচার চা, যেটা প্রায় শোনাই যায় না। তাই নতুন কারও  পক্ষে শুনে বোঝা দুঃসাধ্য যে রহমান চাচা ঠিক কি বিক্রি করছে। লাল চা, দুধ চা, কালো চা, লেবু চায়ের সঙ্গে স্পেশাল চাও আছে চাচার চায়ের ভান্ডারে।  শব্দছকের মধ্যে মাথা গুঁজেই মামা  বলে উঠল,

-   চাচা, লেবু হবে নাকি? -   হবে, কটা?

দাড়িতে হাত বুলিয়ে রহমান চাচা কেটলির দিকে ঝুঁকে ছোট মাটির একটা ভাঁড় ডান হাতে ধরে বাম হাত দিয়ে ঠুকে ঠুকে তার ধুলো ঝেড়ে কেটলি থেকে চা ঢালতে লাগল। সেনদা কতক্ষণে চা শেষ করেন, বা মামা কতক্ষন ধরে চা খায় কিংবা সান্যালদারই বা চা খেতে কতক্ষন লাগে তা চাচার এক্কেবারে মগজস্থ। মাটির ভাঁড়ে শেষ চুমুক দেওয়ার আগেই রহমান চাচা আবার তার কেটলি নিয়ে হাজির হয়ে যায়। চাচার চার  টাকার চায়ের সঙ্গে চার আনার চা ফ্রী। তবে অবশ্যই শর্তাবলী প্রযোজ্য, চার আনার ফ্রী চা শুধু মাত্র নিত্য যাত্রীদের জন্যেই। তবে হ্যাঁ, কেউ যদি খালি ভাঁড়টা ফেলে দেওয়ার আগে চাচার দিকে বাড়িয়ে দেন, চাচা কিন্তু হাসি মুখেই সেই চার আনার চা আবার তাতে ঢেলে দেন, সে তিনি নিত্য যাত্রী হোক না হোক।   

কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন নিত্যর স্টেশনে এসে থামল, আর নিত্য পা বাড়াল প্লাটফর্মের দিকে। হঠাৎ পিছান থেকে আওয়াজ এল,

-   দেব নাকি দাদা ছালটা ছাড়িয়ে নুন ঝাল মাখিয়ে?

নিত্য নিজের মনে একটু হেসে প্লাটফর্মে পা রাখল আর তারপর শুনতে পেল সেই রেলতুতো আত্মীয়ের শেষ কথাটা, -   কচ্চি শসা

 এই অফিস টাইমের লোকাল ট্রেনে এরকম অনেক মানুষ  আছেন  যারা নিজেদের হেঁয়ালি ভরা মজার কথা মানুষের কাছে বিক্রি করে আর সঙ্গে লজেন্স, আপেল, খবরের কাগজ, লাল কালো চা  বা পেনের রিফিল বিনামূল্যে।

 রাতের অন্ধকারে স্টেশন থেকে বাড়ি পর্যন্ত গ্রামের এই রাস্তায় নিত্যর নিত্যদিনের সঙ্গী শুধু বাইকের শব্দ আর তার আলো। নিত্যের পায়ের ধাক্কা খেয়ে  বাইক রাতের ঘন অন্ধকারকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে চোখ মেলে তাকালো আর রেল লাইনের পাশের রাস্তা ধরে বাড়ির দিকে চলতে লাগল। পাশের লাইন দিয়ে এক অশরীরী  ট্রেন অন্ধকার রাতের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়ে নিত্যর পাশে পাশে দৌড়াতে লাগল। ট্রেনের চাকার আওয়াজের সঙ্গে নিত্যর কানে যেন ভেসে এল,

-   আর কারও ঠকবার ইছে নাকি ...... ?

 নিত্য চলতে থাকল বাড়ির দিকে। কালকে ভোরেই তো আবার এই পথেই উল্টো দিকে দৌড়তে হবে। বাকি সবার মতো নিত্য মজুমদার নিজেও যে এক নিত্য যাত্রী।

 

            ***************************

 

 

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

হাত